মৌলভী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া শিবপুরী আল-চিশতী, আল-কাদরী, আল ওয়াইসী
সোহরাওয়ার্দিয়া ত্বরিকা হলো একটি আধ্যাত্মিক মতবাদ।দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি ইরানের শেখ নাজীবউদ্দীন আবদুল কাদির (রহ.) (মৃ. ১১৬৯ খ্রি) এই মতবাদ প্রচার শুরু করেন।তাঁর জন্ম ইরানের জীবাল প্রদেশের সুহরার্দ নগরে।এ কারণেই এ তরিকার নাম হয়েছে সোহরাওয়ার্দিয়া।
আবদুল কাদিরের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ শাহাবউদ্দীন আবু হাফ্স উমর ইবন আবদুল্লাহ (রহ.) এ তরিকার বিশেষ উৎকর্ষ সাধন করেন।এজন্য তাঁকেই সুহ্রাওয়ার্দিয়া তরিকার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়।ইরানের শাসকগণ তাঁর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন; ফারসি কবি হযরত শেখ সাদী (রহ.)ও তাঁর শিষ্য ছিলেন।
সাধক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী ১১৪৫ সালে তার জন্ম হয়।তার জম্ম নিয়ে অনেক ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পাওয়া যায়। পীরদে জীবন বৃত্তান্তে এ ধরনের অসংলগ্নতা ও অসামঞ্জস্যতা প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।প্রাচীনকালে যারা শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর (র.) জীবনবৃত্তান্ত রচনা করেছেন তাদের মধ্যে ইবনে খালেকানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তার নাম আহমদ, কনিয়াত বা উপনাম আবুল আব্বাস।তিনি আহমদ বারমাকী নামেও পরিচিত।আব্বাসীয় যুগে খালেদ বারমাকীর বংশে জন্মগ্রহণ করায় তার নামের সাথে বারমাকী ব্যবহার করা হয়।মোসেলের নিকটবর্তী ইরবিলে হিজরি ৬০৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।বাংলা ভাষায় সুফীতত্ত্বের ওপর প্রচুর বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে এবং তরিকতের আলোচনায় সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার বর্ণনাও স্থান পেয়েছে।শেখ শাহাবুদ্দীন এর জীবনবৃত্তান্ত অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত এবং সংক্ষেপে আলোচিত হলেও সর্বত্র সঠিক ও যথার্থভাবে বর্ণিত হয়েছে বলে দাবি করা যায় না।
আবদুল্লাহ তাসাওউফ বিষয়ে আওয়ারিফ-উল্লমা’আরিফ গ্রন্থ রচনা করেন।তাতে সুফিদের খানকাহ, খানকাহ্র জীবনযাপন পদ্ধতি এবং প্রচলিত নিয়ম-কানুন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।গ্রন্থখানি ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে।ভারতে এ তরিকার আদি পুরুষ ছিলেন শেখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী (১১৬৯-১২৬৬)।সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ তাঁকে ‘শায়খ-উল-ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।শেখ শাহাবউদ্দীন সু্হ্রাওয়ার্দির শিষ্য ও শেখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়ার বন্ধু শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি (র.) লক্ষ্মণসেনের সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং প্রথম সোহরাওয়ার্দিয়া মতবাদ প্রচার করেন।এখানে তাঁর শিষ্যগণ ‘জালালিয়া’ নামে পরিচিত।
শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (র.) এর মতে এই তরিকার ভিত্তি হইলো : ১) জওক (আধ্যাত্মিক স্বাধ গ্রহন) ২) ওয়াজস (উচ্ছাস ও উম্মাদনা)
এই তরিকার সাধকগন কখনো জাহির আবার কখনো বাতিন থাকেন।সিলেটের হযরত শাহ জালাল উয়ামেনী মজিারদেদী (রহ.) সোহরাওয়ার্দী তরিকার অনুসারী ছিলেন।হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী রহ. এই তরিকার জাহেরী ও বাতেনী উভয় অবস্থার ইমাম ও কুতুব ছিলেন।সোহরাওয়ার্দী সম্প্রদায়ের মধ্যে সামা একটি প্রচলিত বিষয়।তারা এর মাধ্যমে হূদয়কে উজ্জীবিত করে ও আধ্যাত্মিকভাবে বিভোর হয়।এরূপ ভাবোন্মত্ত অবস্থায় কখনো কখনো তারা নৃত্যও করে থাকে।
সোহরাওয়ার্দী তার প্রাথমিক শিক্ষা তার চাচা আবু নাজিব সিদ্দিকী সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে নেন।তিনি তার বাগদাদে যান ও সেখানে ইসলামী আইনশাস্ত্র, আইন, যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, কুরআন ও হাদিস শিক্ষা অধ্যয়ন করেন এবং আবদুল কাদের জিলানীর কাছ থেকেও আধ্যাত্মিকতার জ্ঞানার্জন করেন।তিনি দ্রুত তার অধ্যয়নে পারদর্শী হন এবং অল্প বয়সেই শাফেয়ী ও হাম্বলি মাযহাব আয়ত্ত করেন।আব্বাসীয়দের অধীনে খলিফা আল-নাসির দ্বারা সোহরাওয়ার্দীকে অবশেষে শায়খুল ইসলাম হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল।
শেখ শাহাবুদ্দীনের তাসাওফ শিক্ষা সফরে অংশগ্রহণকারী ভক্ত-অনুসারীদের মুখে তার বহু কারামাত বা অলৌকিক ঘটনার বিবরণ শোনা যেত।
বর্ণিত আছে যে, তিনি বহুবার পবিত্র হজ পালন করেন।যাত্রাপথে তার সমসাময়িক সুফী মাশায়েখ লিখিত চিঠিপত্র প্রশ্নাকারে তার হস্তগত হতো এবং তার কাছে জবাব প্রার্থনা করা হতো।তিনি জবাবে বলতেন : এ মাল, ওয়াস্তাগ ফিরিল্লাহা মিনল উজুবি।অর্থাৎ আমল কর এবং অহঙ্কার হতে আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত কামনা কর।
সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা বাংলাদেশে আগমন :
বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায়, শেখ শাহাবুদ্দীনের অনেক ভক্ত-অনুসারী বাংলাদেশসহ পাক-ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন।তাদের মধ্যে শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মূলতনে অবস্থান করেন এবং সেখানে ইসলাম প্রচার করেন।
সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার কোন সাধক প্রথম বাংলাদেশে আগমন করেন? এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলা যায়, প্রথম আগমনকারী সাধকের নাম শেখ জালালউদ্দীন তবরেজী।তিনি সরাসরি শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য বলে বর্ণিত হয়ে থাকে।তিনি মুলতান ও দিল্লির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন।বাংলাদেশে তার শিষ্যরা জলিলিয়া বা জালালিয়া নামে পরিচিত।
একটি বর্ণনা অনুযায়ী বঙ্গ বিজয়ের পরপরই তিনি এদেশে আসেন।১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকালের পর তাকে দেওতলায় সমাধিস্থ করা হয়।তার জন্ম সাল জানা না গেলেও ১২১৩ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন বলে জানা যায়।এটি রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালের ঘটনা।শেখ জালালউদ্দিন তবরেজীর পর সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা বাংলাদেশে কীভাবে বিস্তার লাভ করে তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না।তবে পঞ্চাদশ শতকের জৌনপুরের বিখ্যাত সুফী মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী কর্তৃক জৌনপুরের শর্কি সুলতান ইবরাহিম শর্কির নিকট লিখিত একখানি চিঠিতে বাংলাদেশের কয়েকটি সুফী তরিকার নাম পাওয়া যায়।রাজা গণেশের অত্যাচার থেকে বাংলাদেশের সুফীদের রক্ষা করার জন্য এই চিঠিখানা লিখিত হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, দেবগাঁও (দেবকোটে)-এ শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর সওরজন শিষ্য সমাহিত আছেন এবং দিনাজপুর জেলায় মাহী সন্তোষেও সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার কয়েকজন সুফী সাধক সমাহিত আছেন।
সকল অলি-আউলিয়া কম-বেশী আহমদী নূরের বর্ণনা উপস্থাপন করিয়াছেন।তবে সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকায় ইহার অনেক বর্ণনা খোলাখুলি ভাবে রহিয়াছে।এই তরিকার জ্ঞান সম্পন্ন অলি-আউলিয়ার কিছু কিছু রীতিনীতি, কাজ-কর্ম্ম শরিয়তের বা সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির গণ্ডিভুক্ত না-ও হইতে পারে।ইহা বেলায়েতের প্রভাব মুক্ত এবং শরিয়তের আদেশ-নিষেধ সাময়িক ভাবে রহিত হওয়ার অবস্থা।ইহাকে খিজিরী বেলায়েত বলে।
হযরত শেখ শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) স্বীয় তরিকার বিস্তারিত দর্শন বিষয়ক একাধিক কিতাব রচনা করিয়াছেন।তন্মধ্যে ‘হেকমতে আশরাক’ গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ।তাঁহার তরিকার বিস্তারিত মূলনীতি ও দর্শন এই কিতাবে রহিয়াছে।গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত।প্রথম খণ্ডে যুক্তিবাদ ও দর্শন বিষয়ে আলোচনা করা হইয়াছে।দ্বিতীয় খণ্ডে আনোয়ারে এলাহীর বর্ণনা রহিয়াছে।ইহাতে তাজাল্লিয়াতে রব্বানীর বিশেষ বর্ণনা রহিয়াছে।
ইহা পাঁচ ভাগে বিভক্ত :
১. নূর ও হাকিকত সম্বন্ধে আলোচনা।
২. নূর বিষয়ক শৃঙ্খলা।
৩. নূরুল আনোয়ার, আনোয়ারে কাহিরা, আনোয়ারে মুর্জারাদা সম্পর্কে আলোচনা।
৪. বরজখের প্রকার ভেদ ও নমুনা।
৫. নবুয়াত, মনামত, মা’আদ (প্রত্যাবর্তন) বিষয়ক আলোচনা।
উক্ত পাঁচ বিভাগে রমুজ ও ইশারার সংক্ষিপ্ত আলোচনা রহিয়াছে।নূর ও জুলমাত সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রহিয়াছে।তিনি নূর বলিতে রূহ, জুলমাত বলিতে শরীর এবং আনোয়ার আক্লকে বুদ্ধিবৃত্তি বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন।আক্ল দ্বারা উকুলে আফলাক-ইহার দ্বারা আনোয়ারে কাহিরা এবং আনোয়ারে মুর্জারাদার সংক্ষিপ্ত আলোচনা পরিবেশিত হইয়াছে।আলমে বরজখ দ্বারা আলমে আজসাম বুঝাইয়াছেন।এই ভাবে: জাতে এলাহী, সিফাতে আফয়াল, লজ্জত (স্বাদ), মারেফাত, হেকমতে ইলমে কালাম, দর্শন ও তাসাউস ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিয়াছেন।
কুরআন-হাদিসের সূক্ষ্ম রহস্য পূর্ণ আয়াত ও হাদিস শরীফের উপর প্রতিষ্ঠিত দর্শন ও তরিকা প্রচারের সময়ে ইমাম হযরত শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) বিভিন্ন উলামা ও মাশায়েখের বিরোধিতা ও নির্যাতনের শিকার হইয়াছিলেন।সর্ব্ব শেষে ১২৩৪ খ্রীষ্টাব্দেতিনি শাহাদত বরণ করেন।ইরান, ইরাক সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই তরিকার অনুসারী রহিয়াছেন।
পরিচালক, বিশ্ব আশেকান মজলিশ পাক দরবার শরীফ, শিবপুর, নরসিংদী