সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক ইমারতগুলোর মধ্যে শাহজাদপুর উপজেলার প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন বদর উদ্দিনের মসজিদটি একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন।
স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে এর রয়েছে ভিন্নমাত্রিক গৌরব।এ মসজিদটি ভুমি নকশায় আয়তাকার এবং দুই গম্বুজবিশিষ্ট ইমারত।
বাংলাদেশের মসজিদ স্থাপত্যের ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে প্রথম থেকে আরম্ভ করে শেষ অবধি এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়।তাছাড়া স্বাভাবিক নিয়মে তিন, পাঁচ, ছয়, সাত, নয় ও বহু গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের নির্দশন পাওয়া যায়।
সমগ্র বাংলায় বদর উদ্দিনের মসজিদের ন্যায় এ ধরনের দুই গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ আর দ্বিতীয়টি পরিলক্ষিত হয় না।
বদর উদ্দিনের মসজিদটি প্রধান দুটি কারণে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত : (১) এর বিরল ধরনের দুই গম্বুজবিশিষ্ট আচ্ছাদন (২) ব্যতিক্রমধর্মী টেরাকোটার শিলালিপি।
বদর উদ্দিনের মসজিদটি আয়তাকৃতি।মসজিদটির বাইরের দিক থেকে দৈঘ্য ৯.৩৯ মিটার এবং প্রস্থ ৬.০৭ মিটার।মসজিদটির অভ্যন্তরের দৈঘ্য ৭.৩১ মিটার এবং প্রস্থ ৩.৫৫ মিটার।মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত এ মসজিদের উচ্চতা ৫.৮৯ মিটার।আয়তাকৃতি মসজিটটি তিন বে’ র বদলে দুই ‘বে’ তে বিভক্ত।
সমগ্র বাংলায় দুই গম্বুজবিশিষ্ট এ ধরনের মসজিদের উদাহরণ কেবল বদর উদ্দিনের মসজিদেই দেখা যায়।তবে, মালদার (পশ্চিমবঙ্গ) ১৫৯৫-৯৬ সনে নির্মিত) দুই গম্বুজবিশিষ্ট জামে মসজিদের নাম করা যায়।কিন্তু মালদার দুই গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ বদর উদ্দিনের মসজিদ থেকে ভিন্ন প্রকৃতির।কারণ মালদার মসজিদে তিন ‘বে’ যা বদর উদ্দিনের মসজিদে নেই।
বদর উদ্দিনের মসজিদের সামনের ফাসাদে ৩ টি দরজার সোজাসুজি কিবলা দেওয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় মেহরাবের পেছনে কেবলা দেয়ালে বাইরের দিকে সম্প্রসারিত করা আছে।মসজিদের অভ্যন্তরে দন্ডায়মান কোন স্তম্ভ নেই।মসজিদের পূর্ব ফাসাদে মোট ৩ টি খিলানবিশিষ্ট প্রবেশ পথ এবং পশ্চিম দেয়ালে মোট তিনটি মেহরাব আছে।মেহরাবগুলি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে সংস্থাপিত।
উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে জালি নকশা সম্বলিত গবাক্ষ আছে।অন্যান্য সকল মসজিদ থেকে ভিন্নভাবে এ মসজিদের জুল্লা সমান দুই ভাগে বিভক্ত, কিন্তু মেহরাব এখানে ৩ টি।মসজিদের চার কোণে চারটি পার্শ্বসংলগ্ন বুরুজ আছে।দুটি গম্বুজ কলসচূড়া যুক্ত এবং শীর্ষদেশ পদ্মফুলের সজ্জায় অলংকৃত।পশ্চিম দেয়ালে কেন্দ্রীয় মেহরাবের দুদিকে দুটি অবতল কুলঙ্গি দেখা যায়।অধিকন্তু উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে কুলঙ্গি রয়েছে।
এ মসজিদের সর্বত্রই চর্তুকেন্দ্রিক খিলানরীতি অনুসৃত হয়েছে।খিলানগুলো আড়াআড়িভাবে কর্তৃত হয়ে উপরে গম্বুজ তৈরির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।ফাসাদ এবং কিবলা দেয়াল আয়তাকার ছোট-বড় প্যানেল নকশায় বিভক্ত।
বদর উদ্দিনের মসজিদটি সম্পুর্ণ ছোট ছোট পাতলা ইট, চুন-সুরকি দ্বারা নির্মিত।এ মসজিদে কোনো মিনার নেই।
অতি সম্প্রতি মসজিদের গম্বুজ, অভ্যন্তরে ও বাহিরের দেয়ালগাত্রের রং পরিবর্তন করা হয়েছে।এছাড়া মসজিদের সামনের দিকে টিনের বারান্দার পরিবর্তে কংক্রিটের ঢালাই দ্বারা ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে।
ছাদ নির্মাণের কারণে বারান্দা ঘেরাও দেয়া চুন সুরকির তিন ফুট উচ্চতার দেয়াল ভেঙ্গে দেয়া হয়।দেয়ালে ব্যবহৃত ইটের দৈর্ঘ্য ৮.৬ ইঞ্চি, প্রস্থ ৬.৭ ইঞ্চি, এবং উচ্চতা ১.৬ ইঞ্চি পরিলক্ষিত হয়। মসজিদে আবিষ্কৃত শীলালিখনটি সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী বিসমিল্লাহ দিয়ে আরম্ভ না করে কলেমা তৈয়বা দিয়ে ব্যতিক্রমীভাবে লেখা শুরু হয়েছে।এই শীলালিপির ভাষা ফারসি।
শীলালিপির শেষ অংশে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, মুগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের সময়ে জনৈক বদর উদ্দিন কর্তৃক ১১৫১ হিজরিতে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।
মসজিদটির নির্মাতা বদর উদ্দিনের পরিচয় যাই থাকুক না কেন, তিনি একজন উচ্চাভিলাষী ও ধার্মিক মুসলিম ছিলেন।তিনি তার এই শীলালিপিতে পুনরায় কলেমা তৈয়বা লেখার রীতি প্রবর্তন করেন, যা অনেক আগেই লুপ্ত হয়ে যায়।
শীলালিপির বামদিকে উপরের অংশে চার খলিফার নাম এবং শীলালিপি তৈরির সময় যে শাসক ছিলেন, তার নাম মোহাম্মদ শাহ্ উৎকীর্ণ হয়েছে।এই শীলালিপিটি সাধারণ কোনো শীলাখন্ডে লিখিত নয়।এটা একটা বিরল টেরাকোটা ফলকলিপি।
ফারসি ভাষায় নাস্তালিক রীতিতে উৎকীর্ণ লিপিটির বাংলা অর্থঃ “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নাই মুহাম্মদ তার প্রেরিত পুরুষ” ‘আল্লাহ, মুহাম্মদ, আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী মোহাম্মদ শাহের আমলে’ বদর উদ্দিন “আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক সে ব্যক্তির উপরে যিনি এ পবিত্র ইমারতের প্রতিষ্ঠাতা।
ক্যাষ্ট্রাল সার্ভে জরিপে সেই সাথে রিভিশনাল সার্ভে বা সংশোধনী জরিপে উল্লেখিত ওয়ারিশগণই বদর উদ্দিনের বংশধর।
বদর উদ্দিনের মসজিদের অদূরেই করোতয়া নদীর তীরে অবস্থিত আকৃতির দিক থেকে বড় মখদুমিয়া জামে মসজিদের (দরগাপাড়া) সাথে তুলনা করে ছোট মসজিদ বলেও অভিহিত করা হয়।
মসজিদটি শাহজাদপুর থানার পাশে ছয়আনিপাড়ায় অবস্থিত বলে ছয়আনিপাড়া মসজিদ নামে বেশি পরিচিত।নির্মাতার নাম অনুসারে মসজিদটি স্থানীয়ভাবে বদর উদ্দিনের মসজিদ নামেও খ্যাত।
মসজিদের পূর্ব দেয়ালের বাহিরে মাঝপ্রবেশ পথের উপরে উৎকীর্ণ সন হতে দেখা যায়, মসজিদটি হিজরি ১১০১ (১০৮৯ বাংলা) সনে স্থাপিত হয় এবং তারিখযুক্ত শীলালিপি হতে দেখা যায় যে, ধর্মপ্রাণ বদর উদ্দিনের প্রচেষ্টায় এ মসজিদের নির্মাণ কাজ ১১৫১ হিজরিতে সমাপ্ত হয়।
সম্প্রতি মসজিদ রং করার সময় দেয়ালগাত্রে উৎকীর্ণ সন ও শিলাখন্ডের লিখন রং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
সামগ্রিক পর্যালোচনায় বদর উদ্দিনের মসজিদটি বাংলায় মুগল স্থাপত্যের পতনের যুগে দুই গম্বুজবিশিষ্ট ও বিরল টেরাকোটা শীলালিপির একটি ব্যতিক্রমধর্মী মসজিদ স্থাপত্য নিদর্শন।