গুরু যদি শিষ্যকে একটি অক্ষর বা কর্ম শিক্ষা দান করে সেটাই গুরুবিদ্যা।তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই, যা গুরুর কাছ থেকে না নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় তবে বর্তমান সমাজের মানুষরা গুরুবিদ্যা নিয়েও গুরুর মর্যাদা দিতে চায় না।
আফসোস! বলতে চাই, সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে কখনোই পারবে না।গুরু-শিষ্য এক আত্মার সৃষ্টি হয় তখনি যখন একে অপরকে গভীর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে।
আমি এ আলোচনার শুরুতেই বলতে চাই, শিষ্যের উচিত হবে গুরুদের জন্য নিবেদিত প্রাণ হওয়া, গুরুর কথার ব্যাখ্যা না বুঝে তাঁর সমালোচনা করার মতো-“পাপ”, এই জগতে আর কিছু নেই।অনন্ত জীবন আপনার এই সামান্য ভূলেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।গুরু সমস্ত সমালোচনার উর্দ্ধে।তাঁর কথার সমালোচনা করা তো দুরের কথা, তাঁর ‘কথা বা বাণী’র’ মানে বুঝতে হলেও শিষ্যকে বার বার জন্ম নিতেই হবে।সেটা তো সম্ভব নয়।
আমি এখানে বলবো, শ্রদ্ধেয় গুরুজনের কোনো কথার মানে না বুঝতে পারলে তাঁকে বার বার জিজ্ঞেস করতে হয়।নতুবা নিজের মতো করে মন গড়া কোনো ধরনের ব্যাখ্যা করে নেওয়া ভয়ানক অপরাধ বলেই মনে করি।তবে গুরু পছন্দ করার দ্বায়িত্ব আপনার নিজের কিংবা পরিবারের।তো সেই গুরুকে ‘অবজ্ঞা করার অধিকার’ আপনার নেই।গুরুর সান্নিধ্যে থেকে গুরুর মতো হয়ে ওঠাই প্রতিটি শিষ্যের কর্ত্তব্য।গুরুকে ‘ধরতে’ বড় দেরী নয়, ‘চিনতেও’ বড় দেরী নয়।গুরু-শিষ্য একই আত্মা ও মতাদর্শের হয় তবেই তো ইহজগৎ ও পরজগতের মঙ্গল হবে।
এখানে বলে রাখি যে, জগতের “ভার বহন” করার জন্যই “গুরুর আত্মপ্রকাশ ঘটে”।জগৎ সংসারের সমস্ত কিছুর মূলেই গুরু-শক্তিই কাজ করে।গুরুর ‘ভার বহন’ করার সাধ্য কারোর নেই।
গীতিকার এক গানে বলেন, শিষ্যের বাড়ির ফুল-বাগিচা, ফুলের অঙ্কুর আছে ‘গুরুর ঠাঁই’।”গুরুর অঙ্কুর” না বসিলে তাকে কেবা “শিষ্য” কয়।ফকির লালন বলেন, সাঁইর বচনে শিষ্য হওয়া বড় দায়।তিন মনকে এক মন করে, ঐ চরণে সাধন ভজন করতে হয়।
যাই হোক, আমি শুধু গুরু গুরু করছি, গুরুর অনেক প্রতিশব্দ আছে।যেমন, শিক্ষক, পণ্ডিত কিংবা ওস্তাদ।তো এগুলো সবই এক সুত্রে গাঁথা।মানুষ এই গুলোকে বিভিন্ন জায়গায় সম্মান পূর্বক ব্যাবহার করে শ্রদ্ধা এবং “ভালোবাসা অর্পণ” করে থাকে।এই জগতের মানুষরাই তাঁর সন্তানকে শুধুই জন্ম দেন, তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে একজন দক্ষ গুরু, শিক্ষক, পণ্ডিত কিংবা ওস্তাদ দরকার মনে করে।তাই আমি বলবো যে, এমন পদবীগুলো হচ্ছে নিজ সন্তানের ২য় পিতা কিংবা মাতাও বলা যেতে পারে।
জানা দরকার, গুরু বা উস্তাদ, শিক্ষক বা পন্ডিত যখন যা কিছুর আদেশ করে থাকেন, তখন তা অবশ্যই পালন করা “উত্তম”।আপনার শ্রদ্ধেয় গুরুজনের কোনোধরনের দোষগুণের বিচার না করেই।
এখানে বলে রাখি, এ জগতে যাকে লোকে অতি পবিত্র বা ভালো কার্য্যভাবে, তাকেও “গুরু” যদি নিষেধ করেন, সেই গুলো করা উচিত নয়।আবার লোকে যাকে “ঘোর পাপ” বলে, গুরু যদি তাকে সেই “পাপ” করতেও বলেন, সেই গুলোকেও অম্লান বদনে প্রফুল্ল চিত্তে করাকে গুরু ভক্তির কাতারে পড়ে।
তো কোনো গুরুরাই সেই ‘পাপ’ করার নির্দেশ কখনোই দিবেন না বা দিতে চায় না।গুরুরা সাধনা করেই ‘জ্ঞান’ অর্জন করেছেন।তাই গুরুরা অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি, ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরাও শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত, গুরু বা শিক্ষকের মর্যাদা, সম্মান কিংবা দাম দিয়েই কথা বলেন।এইখানে বারাক ওবামার কথা বলি, ‘যদি আপনি জীবনে সাফল্য অর্জন করে থাকেন, তা হলে মনে রাখবেন যে আপনার পাশে একজন গুরু বা শিক্ষকরা ছিলেন, তারা আমাকে আপনাকে নানান বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন।খোদা বা ঈশ্বরীয় আলোচনায় শ্রদ্ধাভাজন গুরু কিংবা শিক্ষকের মুখের দিকে সু-গভীর দৃষ্টি রেখে শ্রবণ করতে হয়।সেই সময় অবশ্যই ‘শিষ্যদের খেয়াল’ রাখতে হয় যে ঈশ্বরীয় কথা ঈশ্বরীয় আবেশেই গুরুর মুখ থেকে নিঃশৃত হচ্ছে, সেই সময় আপনার মন-কে পুর্ন একগ্রতার সঙ্গে গুরুর উপর নিবেশ করতে হয়।এই বিশ্বাস না রাখলে কখনো আপনি পূর্ণাঙ্গ ‘শিষ্য’ হতে পারবেন না।
এমন আলোচনায় আমরা জানার চেষ্টা করবো, গুরু ও শিষ্য কাকে বলে? ”গু” শব্দে অন্ধকার আর ”রু” শব্দে আলোক।যিনি অজ্ঞান রূপ অন্ধকার নাশ করে কিংবা জীবনের অন্ধকার গুলোকে সমাপ্তি করার উৎসাহ নিয়ে জ্ঞানালোক প্রকাশ করে থাকেন, তিনিই তো গুরু।কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ এবং মাৎসর্য্য-এই ছয় রিপুকে যিনি জয় করেন, তিনিই তো আধ্যাত্মিকতার বিমল পথ অবগত করেছেন, আর যিনি নিষ্কপট ভাবে ইন্দ্রিয় দমন করতে পেরেছেন, তিনিই “সত্যবাদী”, সর্বদা ধর্মের পথে চলেন।যিনি স্থির এবং মনকে পবিত্র রাখেন, তিনিই তো আত্মদর্শন করেছেন, এই গুলো মেনে বা জীবনের সঙ্গে প্রতিফলন ঘটিয়ে জ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছেন।আর সত্যের প্রতি উৎস্বর্গী হয়ে আজীবন সাধনা করেন, তিনিই গুরু হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।সুতরাং এমন গুণ গুলোকেই গুরু বলা যেতে পারে।
এখানে বলে রাখি যে, আমাদের জন্ম দানকারী পিতা-মাতা হলেন পরম গুরু।বাল্যকাল বা শিশু কাল থেকে যিনি সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেন, তিনিই “মহান শিক্ষা গুরু”।সর্বোপরি পরমাত্মাই হল আমাদের “আদি গুরু” পরমাত্মার প্রতি ‘ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও সমর্পণ’ থাকলে, তিনি আমাদের মোক্ষ লাভ করায়ে তাঁর সহিত যুক্ত করে নেন।আর যে মানুষ নিষ্কপট ভাবেই গুরুকে ভক্তি করেন, গুরু ও সৃষ্টি কর্তার ‘ভেদ জ্ঞান’ করেন না, নিজের জ্ঞান বুদ্ধি কোনো অকার্যে প্রয়োগ করেন না, শূন্য মস্তিষ্কে গুরুর নিকটেই ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস এর সহিত জ্ঞান লাভ করেন এবং গুরুর আজ্ঞা পালন করেন তাঁকেই আমরা ‘শিষ্য’ বলতে পারি।
এখন আলোচনায় আসা যাক, গুরু ও শিষ্যর সম্পর্কটা যেন মুক্তির বন্ধন, যাকে মুলত এক অদৃশ্যের বন্ধন বলা যেতে পারে।প্রতিটি শিষ্যের জন্যে একজন গুরু নির্দিষ্ট থাকেন আর সেই শিষ্যকেই যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় গুরুকে।শিষ্যকে যেগুলো গুরু দীক্ষা দেন তার নেপথ্যে গুরুর নিজস্ব কোন স্বার্থ থাকে না।থাকে একটাই লক্ষ্য, শিষ্যকে তার ঠিকানায় পৌছে দেয়া।আর সেখানে শিষ্য পৌছতে পারাই হচ্ছে গুরুর একমাত্র গুরুদক্ষিনা।যাক আলোচনাটি সংক্ষিপ্ত করতে চাই, অনেক ‘জটিল কথা’ থাকলেও অল্প পরিসরে শেষ করছি।শুধু একটা কথাই বলবো যাকে আপনি কোনো সময়ে “গুরু” মেনে ছিলেন তাকে কখনোই অশ্রদ্ধা করবেননা।সার্থক হোক আমার আপনার গুরুশিষ্যের মেইল বন্ধন।আমরা খুব সহজেই যেন গুরু অমৃতের পথে যাত্রা করতে পারি।
লেখক:
নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং অধ্যাপক।