শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম :
একটি ছোট্ট গাছের ডালের পর টুনা ও টুনি বাসা বাঁধার সিদ্ধান্ত নিল।বনে বনে আর কত ঘুরে বেড়াবে।দুজনেরই বয়স হয়েছে; এখন একটা স্থায়ী ঠিকানা দরকার।তাই তারা বাসা বেঁধে ঘর বাঁধতে চায়; সংসার পাততে চায়।তাদের মিলনে আসবে আরও কত না সন্তান-সন্তুতি।সেইসব সন্তানেরা কিচিরমিচির করে তাদের চোখের সামনে উড়ে বেড়াবে।আর সেই আনন্দ মুহুর্তটুকু টুনা ও টুনি দূর থেকে প্রাণ ভরে অবলোকন করবে এবং মনের সুখ প্রশান্তিতে দিনকাল অতিবাহিত করবে।তারা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে তখন তাদের সন্তানেরা যত্নআত্মি করবে।এমন নানাবিধ কথা বার্তা একে অপরের সঙ্গে বলাবলি করছে।
এরপর নতুন বাসার কাজ শুরু করল।দীর্ঘদিন টুনাটুনির কঠোর পরিশ্রমের ফলে বাসা নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হলো।
টুনা ও টুনি চিন্তা করল যে, পরবর্তীকালে কোনো পাখি যেন কোটা দিতে না পারে।আমরা নতুন ঘর নির্মাণের সময় কাউকে কিছু খাওয়ানি বা তারা শুনতেই পায়নি।তাই অসংখ্য পরিচিত আত্মীয়দের দাওয়া করে তাদের নতুন বাসায় আমন্ত্রণ জানাল।তাদের অতিথিরা বাসায় আসল একটি লাল ফিতে কেটে উদ্বোধন করল।টুনা ও টুনি সেই অনুষ্ঠানে কোনো কার্পন্ন করেনি বেশ জাকজমকভাবেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করল।
এরপর থেকে টুনা ও টুনি এক সাথে থাকতে শুরু করে। কিছুদিন পর টুনি সেই বাসার ভেতর দু’টি ডিম পারে। সেই ডিম দেখে টুনা আনন্দে আটখানা প্রায়। তাদের অনাগত সন্তানদের নিয়ে নানান চিন্তা ভাবনা শুরু করে। টুনি ও টুনা সম্মিলিতভাবে ডিমে তাপ দেওয়া শুরু করে। তার কিছু দিন পর সেই ডিম থেকে দু’টি ফুটফুটে ছেলে বাচ্চার জন্ম হয়। টুনা ও টুনি এত উচ্ছ্বসিত হয়েছে যে, তারা আবারও সকল আত্মীয় স্বজন শুভাকাঙ্খিদের দাওয়াত করে বিরাট আয়োজন করে, কোনো কিছু কমতি করেনি। সকল আত্মীয় স্বজন
এসে তাদের সন্তাদের মুখ দেখে এবং দীর্ঘ হায়াতের জন্য দোয়া করে যায়।সেই সন্তাদের বড় করে তুলতে দিন পর দিন, মাসের পর মাস, বনে বনে ঘুরে ঘুরে আহার সংগ্রহ করে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। রোদ, ঝড়-বৃষ্টিতে তাদের নিরাপত্তার সুবিশাল এক দায়িত্ব কাঁধে নেয়। নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়। শত ঘাতপ্রতিঘাতের মাঝেও টুনাটুনি পিছ পা হয়নি কখনো।
এভাবেই হাজারও পরিশ্রম করে সন্তানদের বড় করে তুলে, তারা হাঁটতে শিখে, কথা বলতে শিখে, উড়তে শিখতে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে শিখে, নিজে নিজে খাবার সংগ্রহ করে খেতে শিখে। তাদের সামনে কিচিরমিচির করে বেড়ায় বাবাকে বাবা ডাকে আর মা’কে মা বলে।
সময়ের বিবর্তনে সকলকিছুই পাল্টেছে। তারা একদিন ভেবেছিল যে, অসংখ্য সন্তানের পিতামাতা হবে। কিন্তু তাদের বর্তমান দুই সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে আর কোনো সন্তান নেয়নি। তাদের এখন বয়স্ক হয়ে গেছে সন্তানেই বা আসবে কোথায় থেকে। সন্তানেরা আর আগের মতো নেই। তারা সবকিছু বুঝতে শিখেছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে, এভাবে আরও দীর্ঘদিন কেটে গেল। সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে, সারাদিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এইদিকে তাদের পিতামাতা সারাদিন কি হালতে আছে তার কোনো খোঁজখবর নেয় না।
সন্তানেরা বাসায় ফিরার পর পিতামাতা জিজ্ঞেস করে। তোমরা সারাদিন কোথায় ঘুরে বেড়াও? এদিকে যে আমরা দু’জন আজ কয়দিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি সেইদিকে তোমাদের কী কোনো খেয়াল আছে। সন্তানেরা উত্তর দেয়: তোমাদের যথেষ্ট পরিমানে বয়স হয়েছে। পাখিদের বয়স হলে একটু অসুস্থ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এত চিল্লাচিল্লি করবে না তো:
অন্য পাখিরা ঘুমাচ্ছে। আর আমরাও সারাদিন ঘুরাফিরে খুব ক্লান্ত এখন ঘুমাতে যাবো। তোমরাও পারলে একটু ঘুমাও না হলে যে, তোমাদের কিচিরমিচির শব্দে আমরাও ঘুমাতে পারবো না। তোমরা আমাদের জন্য কী করেছ? একটি বাসাতে গাধাগাধি করে ঘুমাতে হয়, জীবনে কোনো কিছুই সঞ্চয় করনি, হৈহুল্লোর আর বিলাসিতা করে সব শেষ করে রেখেছ। মা পাখিটি এবার উত্তর দেয়: তোমরা আমাদের সাথে এরকম আচরণ করতে পারো না। কেননা, তোমার বাবার কোনো বাজে অভ্যাস ছিল না। তার সমস্ত জীবনীশক্তি তোমাদের পিছনে আমার পিছনে ক্ষয় করেছে। তোমাদের ভরণপোষণ দিয়েছে। তোমাদের জন্য হাজারও পরিশ্রম করে একটি বাসা নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি অসুস্থ হয়ে যাবার পর থেকে তার সমস্ত সময় আমার পিছনে খরচ করছে। আমাকে টানতে টানতে আজ সেও নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ তোমরা কিছুই বুঝতে পারছ না। একদিন তোমরা ঠিকই বুঝতে পারবে; আমরা যেদিন থাকব না। দেখবে তোমাদেরও একদিন সন্তান হবে এবং তোমাদের সাথেও যখন ঠিক একই রকম আচরণ করবে। সন্তানেরা উত্তর দেয়: যদি আর একটি কথা বলো: তবে এক্ষুনি নিচে নামিয়ে দিয়ে আসব, আর কোনোদিন বাসায় তুলে আনব না। এরপর পিতামাতা দুজনই শান্ত হয়ে যায়। বুকচিরে কান্না আসে –এই বেদনা করো কাছে প্রকাশে করতে পারে না। পুরুষ পাখিটি স্ত্রী পাখিটিকে সান্ত্বনা দেয়: দুঃখ করো না এ আমাদের কপালের লিখন; ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কত আশায় বুক বেঁধেছিলাম ওরা একদিন পাখিদের মত পাখি হবে, আমাদের দুঃখ কষ্ট বুঝবে। কিন্তু ওরা পাখিতে হবে পারেনি। দোয়া করি –তবু ওরা ভালো থাকুন সবসময়।
এভাবে আরও দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়।পুরুষ ও স্ত্রী পাখিটি জীবনের শেষ প্রান্ততে চলে আসে।হঠাৎ একদিন পুরুষ পাখিটি শয্যায়।চিৎকার ও আহাজারি করে তার সন্তানের মুখটা শেষ বারের মতো একবার দেখার জন্য।কিন্তু তা আর কিভাবে সম্ভব।তারা যে অন্য ডালে গিয়ে বাসা বেঁধেছে; নতুন করে সংসার পেতেছে তাদেরই যে স্ত্রী আছে সন্তান আছে, তাদের নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকে।পিতার মৃত্যুশয্যায় তার পাশে থাকার মতো সময় কই? এমনভাবে হাজারও আহাজারি করতে করতে পুরুষ পাখিটি মারা যায়।এক পাহাড় সমান কষ্ট বুকে নিয়ে।সাথে সাথেই স্ত্রী পাখিটি চিৎকার দিয়ে বলে উঠে ওগো তুমি একি করলে; এখন আমার কি হবে? স্বামীর মৃত্যুর কষ্ট সইতে না পেরে পুরুষ পাখিটির বুকের পরে সেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এভাবেই দুটি পাখি দীর্ঘসময় তাদের বাসায় মরে পড়ে থাকে।তাদের দেখার মতো কেউ নেই।আত্মীয়স্বজন দূরে তাদের আপন সন্তানেরাও পাশে নেই।অবস্থায় কেউ তো কোনো খোঁজখবর নেয়নি।মৃত্যুর পরেও না।
হঠাৎ প্রতিবেশি একটি পাখি কৌতুহলবশত তাদের অসুস্থতার কথা জানতে আসে।এসে দেখতে পায় যে, তারা মারা গেছে।সাথে সাথে ওই পাখিটি তারা দুজনের মৃত্যুর সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে দেয়।তখন সব পাখি জানতে পারে।তাদের দুই সন্তানরাও খবর শুনে আসে স্ত্রী পুত্রসহ। সকলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে; এক ভাই আরেক ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে আর বলে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের পিতামাতার সাথে অন্যায় করেছি।আমাদের এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই। দুই ভাইয়ের সন্তানেরা তাদের পিতাদের কাছে এবার প্রশ্ন করে: আমাদের যে দাদা দাদিমা আছে তা তো কোনোদিন বলনি? তাদের আদর ও স্নেহ ভালোবাসা থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছ; নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করব যে রূপ তোমরা তোমাদের পিতামাতা সঙ্গে করেছ। এবার দুই ভাই চিন্তা করে ও জীবনের সমস্ত ভুলভ্রান্তি বুঝতে পারে। কিন্তু সেই সঠিক পথটি বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। যখন আমাদের পিতামাতা এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল।ডুকরে ডুকরে কাঁদে আর অসহায় পিতামাতার প্রাণবিহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে সেই নসীহতের কথা মনে পড়ে।আর বলতে থাকে আমাদের মতো হতভাগা পাখি এই পৃথিবীতে আর যেন জন্ম না নেয়, সব পাখিরা পাখিদের মতো পাখি হয়ে উঠুক।তাদের পিতামাতাকে ভালোবাসুক যত্নআত্মি করুক। পাখিদের সমাজ হয়ে উঠুক চির উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ।
লেখক- কবি, ছড়াকার, গবেষক ও কলামিস্ট
সম্পাদক ও প্রকাশক : দৈনিক দিকের বার্তা
ঠিকানাঃ বাউশাম, কলমাকান্দা, নেত্রকোনা