বাঁশ আর বেতকেই জীবিকার প্রধান বাহক হিসাবে ধরে রেখেছেন ঐতিহ্যবাহী চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলাধীন ১৬নং সুলতানাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি পরিবার।কিন্তু দিন দিন বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় অভাব অনটনে দিন পার করছেন বাঁশমালীরা।
জানা যায়- পূর্ব পুরুষদের কাছে পাওয়া বংশ পরম্পরাই এ পেশায় গত কয়েক বছরে আগে বেশ সফলতা ছিল।কিন্তু প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বাজারে আসার কারণে কমে গেছে বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা।
অন্যদিকে, প্লাস্টিক পণ্যের দাম বাঁশের তৈরি পণ্যের চেয়ে অনেক কম।আগে ৫০০ টাকার বাঁশ কিনে সেই বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরি করে ১ হাজার ৫’শ টাকা বিক্রি করা যেত।কিন্তু বাঁশের দাম বাড়ার কারণে এখন ৫০০ টাকার বাঁশ কিনে সেই বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরির পর ১০০০ টাকাও বিক্রি করা যায় না।
বাঁশমালীরা জানান- ৫০টি পরিবার বাঁশের তৈরি চাটাই, খাঁচা, বিটে, পলও, আন্টা, কুলা, পাখা, ডালি, ভাড়, ঝাড়ু, হাসঁ-মুরগি রাখা খাঁচাসহ নানা পণ্য তৈরি করে হাট-বাজারে বিক্রি করে কোন মতো চলে তাদের সংসার।বাঁশের তৈরি পণ্য ছাড়া অন্য কোন কাজ তাদের জানা নেই।তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এটা করতে করেন।সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিলে পরিবারগুলো আরও ভালো পণ্য তৈরি করে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে জানান বাঁশমালিরা।
ওই গ্রামের দ্বিজলাল বিশ্বাস বলেন, এ সব জিনিসপত্র তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ।বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ সংগ্রহ করার পর তা দা-ছুড়ি দিয়ে তা চিরানো হয়।পরে বাঁশগুলো পণ্যের মানভেদে চিকন আকারের শলা বা বাতি তৈরি করে রোদে শুকাতে হয়।এরপর বানানো হয়ে থাকে নানা দ্রব্যসামগ্রী।এ কাজটি তার বাপ-দাদার আমল থেকে করে আসছেন।তবে পুঁজি থাকলে এই পেশায় স্বাবলম্বী হওয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে একজন উদ্ধর্তন কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি পেশার মানুষকে এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।বাঁশমালীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে, শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইন এর তিন ছেলে মনিন্দ্র চন্দ্র সরকার, বাবুল চন্দ্র সরকার ও প্রিয়লাল চন্দ্র সরকার এবং একমাত্র মেয়ে মনি রাণী সরকার।
এরমধ্যে গেলো বছর ২৫ ডিসেম্বর জন্ডিস ও লিভার কান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তাঁর ছোট ছেলে সুজাতপুর বাজারের টেইলার্স প্রিয়লাল সরকার (৪৫) এবং গেলো ৪/৫ বছর আগে তাঁর সহধর্মিনীও না ফেরার দেশে চলে গেছেন (দিব্যান লোকন্ স্ব গচ্ছতু)।
প্রিয়তমা স্ত্রী আর আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে শতবর্ষী যদুলাল বাইন আজ অসহায়।পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ বয়সেও নিরলসভাবে কর্ম করে যাচ্ছেন চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলাধীন সুলতাবাদ ইউনিয়নস্থিত কোয়রকান্দি গ্রামের ১’শ ১৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ যদুলাল চন্দ্র বাইন।বাঁশের তৈরি পণ্য বিক্রি করেই চলে শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইনের সংসার।
শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইনের নাতনি অমল চন্দ্র সরকার বলেন, অতীতে গ্রামেগঞ্জে বাঁশের তৈরি পণ্যসামগ্রীর কদর ছিল অনেক।এ সব পণ্য শোভা পেত প্রত্যেক বাড়িতে।এ ছাড়া গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার দ্রব্যাদি, ডালা, চালুন, ডুলি, খরপা, চাটাইসহ অসংখ্য জিনিস আজও তৈরি করে ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।তবে ইদানিং প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন তা হারিয়ে যেতে বসেছে।বর্তমানে এ ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো চলছে দুর্দিন।বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বাঁশের পণ্য তৈরি ও তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার।
তিনি আরও বলেন, সরকারি ও বে-সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিকভাবে সহায়তা পেলে বাঁশ শিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
স্থানীয় মেম্বার আবদুল হক মৃধা বলেন, বাঁশের তৈরি পণ্য বাঙালির পুরোনো ঐতিহ্য।পুরোনো এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে।কিন্তু পূর্ব পুরুষের এই পেশাকে এখনো ধরে রেখেছেন কোয়রকান্দি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার।বাঁশের পণ্যসামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঁশমালীরা।তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় নানা রকমের বাঁশের তৈরি পণ্য।পূর্ব পুরুষদের এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে তারা এখানো তৈরি করছেন ঝুড়ি, ডালা, কুলা, চালুনি, খলুই, হাতপাখাসহ নানা পণ্য।
মতলব উত্তর উপজেলাধীন সুলতানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক খোকন বলেন, এটি একটি লাভজনক পেশা।বাঁশ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।