ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ।গ্রীষ্মের দুপুর।ঘামে ভেজা শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে উত্তাপ।হাতে ব্যানার- ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ।
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ফুঁসে উঠেছে।ক্যাম্পাসে গর্জন, “কোটা পূর্ণবহাল চাই না”, “কোটা মুক্ত রাষ্ট্র চাই!” এই স্লোগানগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। শুধু টিএসসি প্রাঙ্গণেই নয়, এই আওয়াজ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়—একেকটি ক্যাম্পাস যেন পরিণত হয় নতুন সংগ্রামক্ষেত্রে।শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে, মিছিল-সমাবেশে তাদের গলা ফাটায়, দাবি জানায়—“কোটা প্রথা নিপাত যাক!” তাদের চোখে ঝকঝকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
কিন্তু ৪ জুলাই আসে নতুন এক ধাক্কা।সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের পূর্বের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দেয়।বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হৃদয় যেন টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কেউ কেউ হতাশা চাপতে পারেনি, আবার কেউই হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
৬ জুলাই। শিক্ষার্থীরা ডাক দেয় এক নতুন কর্মসূচির—‘বাংলা ব্লকেড’। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, বরিশাল থেকে রাজশাহী—সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের উত্তাপ। রাস্তাঘাটে বসে শিক্ষার্থীরা।যানবাহন থমকে যায়, শহর যেন এক অবরুদ্ধ কারাগার। ব্যানারে, প্ল্যাকার্ডে, স্লোগানে তাদের একটাই কথা—“বৈষম্যবিরোধী সংগ্রাম চলবেই।” সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা আরও সোচ্চার হয়।তাদের চোখে-মুখে একটাই সংকল্প—এই আন্দোলন নতুন প্রজন্মের এক যুদ্ধ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অদম্য লড়াই।ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাস, শহর থেকে গ্রাম, একটিই নাম—‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। নতুন দিনের আশায়, সমতার জন্য, বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার এক নতুন অধ্যায়ের শুরু।
________________
১১ জুলাইয়ের দুপুর। ঢাকা শহর উত্তপ্ত। হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা এসে পৌঁছেছে; বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারে। কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগও থাকবে। কিন্তু এই নির্দেশনায় কোনো আশ্বাস খুঁজে পায়নি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি একটাই—কোটা সংস্কারে সংসদে আইন প্রণয়ন। আইন না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটার কোনো প্রশ্নই নেই তাদের।বাতাসে যেন বারুদের গন্ধ। আন্দোলনকারীদের প্রতি পুলিশের কড়া সতর্কবার্তা আর মন্ত্রীদের আপোসের আহ্বান সত্ত্বেও তারা দমে যায়নি। বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে তারা ঘোষণা করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের চোখে ভর করেছে অদম্য প্রতিজ্ঞা; এ কোনো সাধারণ আন্দোলন নয়, বরং ন্যায্য অধিকারের দাবিতে এক প্রজন্মের সংগ্রাম।রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। মুখে একই স্লোগান, হাতে একই দাবি। সাদা শার্ট, ফেডার জিন্স, আর স্লোগান লেখা পোস্টার হাতে তারা যেন শহরের প্রতিটি কোণায় নতুন করে ইতিহাস লিখছে। পুলিশও বসে নেই। উত্তপ্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা দাঁড়িয়ে আছে ঢাল হয়ে। কিন্তু যতক্ষণ শিক্ষার্থীদের চোখে প্রতিজ্ঞার সেই অগ্নিশিখা জ্বলছে, ততক্ষণ তাদের আটকানো কি আর সম্ভব!এক সময় সংঘর্ষের শুরু। টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে রাস্তা, কান ফাটানো সাইরেন, আর উত্তপ্ত ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝেও শিক্ষার্থীরা অটল। কয়েকটি স্থানে পুলিশ আর আন্দোলনকারীদের তীব্র সংঘর্ষ ঘটে যায়, যা মুহূর্তের মধ্যেই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। এই আন্দোলন শুধু কয়েকজন শিক্ষার্থীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নয়; এটি হয়ে উঠেছে পুরো একটি প্রজন্মের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রতীক। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর, যা প্রতিধ্বনিত হবে কালের গর্ভে।
১৪ জুলাই। সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তাগুলো যেন অন্যরকম এক উত্তেজনায় ভরপুর। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দিতে বেরিয়েছে। সারাদিনের রোদ, ক্লান্তি, ঘাম কিছুই তাদের দমাতে পারেনি। শিক্ষাব্যবস্থার সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে গণপদযাত্রায় তারা যখন রাস্তায় নেমে আসে, তাদের কণ্ঠে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়।
কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যা বদলে দিল সবকিছু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’দের সঙ্গে তুলনা করেন। তার এই মন্তব্য যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যে এই মন্তব্য ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ক্ষোভে ফেটে পড়ল শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা থেকে রাত, আর রাত পেরিয়ে ভোর পর্যন্ত তাদের বিক্ষোভ থামার কোনো লক্ষণ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররা জড়ো হতে থাকে। ব্যানার হাতে, স্লোগান দিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানানোর দৃঢ় সংকল্প স্পষ্ট। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল স্লোগান—“তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।” এই স্লোগানগুলো শুধু ক্ষোভ প্রকাশ নয়, বরং শেখ হাসিনার মন্তব্যের বিরুদ্ধে এক সরাসরি বিদ্রোহ। শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তাদের অধিকার আদায়ে তারা কোনো অপমান সহ্য করবে না।
প্রতিটি ক্যাম্পাস যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মিছিল, শ্লোগান, এবং বিদ্রোহের অগ্নিশিখায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে চারদিক। তরুণ প্রজন্মের এই প্রতিবাদ শুধু কোটা সংস্কারের দাবি নয়; এটি ছিল এক অগণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা। শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ আরও প্রমাণ করে যে অন্যায় আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা কখনো নীরব থাকবে না।
রাত পেরিয়ে ভোর আসে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মুখে সেই একই স্লোগান—তাদের চোখে অটল প্রতিজ্ঞা। এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অবিচল সংকল্প। তারা জানিয়ে দিল, অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই কখনো থামবে না।
ঠিক পরেরদিন; ১৫ জুলাই, ২০২৪।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে উঠেছিল সেদিন। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল, তাদের হাতে ছিল ন্যায্য অধিকার আদায়ের স্লোগান লেখা পোস্টার। কিন্তু কে জানত, সেই দিনটি তাদের জীবনে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছিল উত্তপ্ত। হঠাৎই চারপাশের পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী দলের কর্মীরা অতর্কিতে হামলে পড়ল নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর। সাদা শার্ট আর জিন্স পরা সেই তরুণ-তরুণীদের হাতে ছিল না কোনো অস্ত্র, ছিল কেবল স্বপ্ন আর অধিকার আদায়ের স্পৃহা। কিন্তু সেদিন তাদের সেই নিরীহ চোখের সামনে নেমে এলো নির্মমতার অন্ধকার।
সন্ত্রাসী হামলাকারীদের হাতে ছিল লাঠি, রড, লোহার পাইপ—আর তাদের আঘাতে রক্ত ঝরছিল তরুণদের মাথা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরটি মুহূর্তেই এক রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। একপাশে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে কেউ, অন্যপাশে কাঁদছে কারও বন্ধু, আর কোথাও মাটিতে পড়ে ছটফট করছে আহত কোনো শিক্ষার্থী। কান্না, চিৎকার, আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল সেদিনের বাতাস।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও যেন সেই নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পায়নি। আহতদের সেবা দেওয়ার জন্য যেখানে যাওয়া হয়েছিল, সেখানেও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। শিক্ষার্থীরা সান্ত্বনা ও সুরক্ষার আশায় হাসপাতালে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানেও তাদের ভাগ্যে জোটে ভয় আর আতঙ্ক।হাসপাতালের পবিত্রতা ভুলে গিয়ে আক্রমণকারীরা সেখানেও হানা দেয়, আঘাত করতে থাকে নিরাপরাধ শিক্ষার্থীদের ওপর। চারদিকে শুধুই অসহায় আর্তনাদ আর মানবতার চিৎকার।
অপরিকল্পিত আক্রমণের মুখে পড়ে আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পেল না শিক্ষার্থীরা। কেউ মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত, কেউবা হাত-পা ভেঙে অসহায়ভাবে পড়ে আছে। কারও শরীর ক্ষত-বিক্ষত, আর কারও মানসিক দৃঢ়তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আহতদের সংখ্যা একসময় তিন শতাধিক ছাড়িয়ে যায়; রক্তাক্ত সেই দিনটি যেন সবার মনে এক গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে হারিয়ে গিয়েছিল মানবতা। শিক্ষার্থীদের চিৎকার আর আর্তনাদের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছিল তাদের স্বপ্ন। তাদের চোখে ভাসে রক্তাক্ত সেই দিনের স্মৃতি—নির্দয় আঘাতে ভরা সেই বিকেল, যা কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই দিনটি ছিল শুধু একটি কালো অধ্যায় নয়, বরং এক প্রজন্মের বেদনার অবসানহীন গল্প, যা তাদের হৃদয়ে চিরকাল থেকে যাবে। তবুও শিক্ষার্থীরা থেমে নেই।
১৬ জুলাই। যেদিনটি ইতিহাসের পাতায় আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকা শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সেইসাথে চট্টগ্রাম, রংপুর—সারা দেশের বাতাসে যেন বারুদের গন্ধ। উত্তেজনা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমের হেডলাইন পর্যন্ত। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বর্বর জুলুম নির্যাতন এবং নির্মমতার খবর ছড়িয়ে পড়ছিল মুহূর্তে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো, তখন পর্যন্তও কোনো মিডিয়া চাইলেও নিউজ কাভার করতে পারেনি। এইযে স্বৈরশাসকের কাছে জিম্মি বলে। সেদিন পুরো দেশটাই থমকে গিয়েছিল, চারদিকে কেবল ধোঁয়া আর চিৎকারের প্রতিধ্বনি।
সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়; অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেওয়া হলো হল খালি করতে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা পিছু হটল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষগুলো একের পর এক ভেঙে চুরমার করে তারা যেন নিজেদের প্রতিবাদ স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
কেউ কেউ বুকভরা সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ায়, ভয় ভুলে তাদের প্রতিবাদে শামিল হয়। এই আন্দোলন আর শুধু কোটার দাবিতে সীমাবদ্ধ নেই, এটি রূপ নিয়েছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিরোধে।
তবে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিভীষিকাময় দিনটি সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। সেই দিনটি হয়ে উঠল সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়। আবু সাঈদ। একজন নিরীহ শিক্ষার্থী। রাজনীতি তার জীবনের কোনো অংশে ছিল না। সাঈদ ছিলেন একজন মেধাবী প্রতিভাবান ছাত্র, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক খেটে খাওয়া কৃষকের ছেলে, বাবা মা এবং বোনের স্বপ্ন পূরণ করতে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে হলেও পড়ালেখা করা। কিন্তু সেই নিরীহ সাঈদকেও সেদিন নির্মমতার শিকার হতে হলো।
আবু সাইদ বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে ছিল সাহসের মূর্ত প্রতীক হয়ে, শিরায় শিরায় প্রবল আত্মবিশ্বাস। তাকে পু’লিশ সত্যিই গু’লি করবে, এই আশঙ্কা তার মনে হয়নি। মনে হয়েছিল, সামনাসামনি দাঁড়ালেই বুঝি সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে, সামনের মানুষগুলোও তো তার মতোই—একই মাটি, একই ভাষা, একই রক্তের ধারা। কিন্তু সেদিন, আবু সাইদের পৃথিবীটা বদলে গেল।
প্রথম গু’লিটা এসে বুকের মাঝখানে লাগল। আবু সাইদ কেঁপে উঠল, বিশ্বাস করতে পারছিল না। মনে হলো, পৃথিবী যেন থেমে গেছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল, কিন্তু পা দুটি শক্ত করেই রাখল। বন্ধুরা কী বলবে? একটা গু’লির আঘাতে সে পড়ে গেছে? বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেনি? না, আবু সাইদ কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। বুকে গর্ব নিয়ে, চোখে অভিমান নিয়ে মনে মনে বন্ধুদের বলল, “দেখছিস, তোরা কেমন দাঁড়িয়ে আছি!”
তার ভেতরের সব শক্তি শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু মাটি থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল আবার। দ্বিতীয় গু’লিটা তখনই এসে তার শরীরে লাগল। এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, সারা শরীরের তীব্র যন্ত্রণা তাকে নুইয়ে ফেলল।
কিন্তু হাল ছাড়ল না সে। ভেঙে পড়ার আগে ভাবতে লাগল তার জীবনের গল্পগুলো—গাঁয়ের মাটির সোঁদা গন্ধ, মা-বাবার চেনা মুখ, ছোট বোনের হাসি। এ গল্পগুলো এখন ম্লান হয়ে আসছে। আবু সাইদের চোখে একসময় সাফল্যের স্বপ্ন ছিল, তার বৃত্তি পাওয়ার আনন্দ ছিল, মায়ের মুখের হাসি ছিল, বাবার বুকে মাথা রেখে শোনানো গল্প ছিল। ইতিমধ্যে আর কোনো শক্তি নেই। শক্তি কাজ করছে না। ঠিক তখনই আরেকটি গুলি এসে শরীরে ছেদ করলো।
সে তো শুধু একটি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। তার জীবনের একেকটি কষ্টের গল্প যেন আজকে এই শহরের রাস্তায় এসে থেমে গেছে। তার বাবা-মা ভেবেছিল, ছেলেটা পড়াশোনা শিখে একদিন তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাদের কষ্টের দিন ফুরিয়ে যাবে। ছোটবোনটা কী আশায় শেষবার তাকে জড়িয়ে ধরেছিল—“দাদা, তুই ভালো থাকিস, তাড়াতাড়ি ঘরে আয়।”
আবু সাইদের ফেরার কথা ছিল রাত দশটায়। এখন কয়টা বাজে? এদিকে রাস্তার ধুলো তার শরীরে মিশে গেছে, আর মায়ের গায়ের সেই মাটির গন্ধটা কেমন যেন বারুদের মতো লাগছে। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তার এই বুকের ভেতর কত রংধনুর স্বপ্ন ছিল, কত অজস্র ভালোবাসা ছিল। কিন্তু আজ, এই শেষ মুহূর্তে সেই স্বপ্নগুলো যেন বারুদের ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে।
আবু সাইদের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে, মাটি তাকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে। শেষ পর্যন্ত সে বুঝল, এই দাঁড়িয়ে থাকা শুধু তার একার লড়াই নয়; এটা তার বন্ধুর, তার পরিবারের, তার গ্রামের সব মানুষের লড়াই। আবু সাইদ জানত না কেন, কিন্তু তার বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ছিল না পিছু হটা। আর এটাই ছিল তার সত্যিকার বিজয়।
তার কাঁপা ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি—“দেখিস, তোরা, কেমন বুক চিতিয়ে দাঁড়াইছিলাম।” আবু সাইদের গল্পটা এখানেই শেষ, কিন্তু তার সাহসের গল্পটা থেকে গেল মানুষের মনে, পথের ধুলোয়, আর বুকে জমে থাকা অভিমানের ছায়ায়। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও বুক চিতিয়ে জিতে গেছে।
আবু সাঈদের সেই রক্তাক্ত মুখ আর চোখে জমে থাকা ভয়ের ছায়া যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায় আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কতটা মূল্য দিতে হয়। সেদিনের সেই রক্তাক্ত সকাল একটি প্রজন্মের জন্য হয়ে রইল অমোচনীয় কালো অধ্যায়, যা কেবল বেদনা আর প্রতিবাদের স্মৃতি হয়ে সবার মনে রয়ে যাবে।
পরের দিন সতেরো জুলাই: শোকের পরিণতিতে জন্ম নিল প্রতিরোধের আগুন।ঢাকা শহরের আকাশ ভোরের আলো ফোটার আগেই ভারী হয়ে উঠেছিল শোক আর অশ্রুজলে। আগের দিনের মৃত্যুর বেদনাদায়ক স্মৃতি যেন পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর এই শোক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোণায়। নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আয়োজন করা হয়েছিল ‘গায়েবানা জানাজা’। সাদা কাপড়ে মোড়ানো প্রতীকী কফিনগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়জনেরা, চোখে অশ্রু আর বুকভরা কষ্ট। শোকের মধ্যেও সবার হৃদয়ে যেন জ্বলছিল এক অনির্বচনীয় আগুন।
কিন্তু শোকের এই পবিত্র মুহূর্তে ঘটে গেল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। জানাজার মাঝেই পুলিশের লাঠির আঘাতে রণক্ষেত্রের রূপ নেয় পুরো স্থান। শিক্ষার্থীরা হঠাৎ বুঝে গেল, তাদের সামনে আরেকটি যুদ্ধের সূচনা হয়ে গেছে। প্রার্থনার ভাষা ঢেকে গেল চিৎকারে, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল সবার। সাদা কাপড়ের কফিনের পাশে অনেক শিক্ষার্থী লুটিয়ে পড়ল আহত হয়ে, কিন্তু তাদের চোখে ফুটে উঠল অদম্য প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞায় মিশে ছিল দুঃখের আগুন, যা কোনোভাবেই নেভানোর নয়।
সেই রাতেই আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিল, শোক দিয়ে এই অন্যায় রোধ করা সম্ভব নয়। তাই পরদিন সারাদেশে ঘোষণা করা হলো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। হাসপাতাল আর জরুরি পরিষেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে। যেন পুরো দেশ স্তব্ধ হয়ে যাবে, যেমন থেমে গিয়েছিল সেই তরুণদের প্রাণ। শিক্ষার্থীরা ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জারসহ সমস্ত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় তাদের বার্তা। সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানানো হলো পাশে দাঁড়ানোর জন্য। দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রতিরোধের ডাক ছড়িয়ে পড়তে লাগল, আর স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল।
শাটডাউনের দিন প্রতিটি শহরের মোড়ে, প্রতিটি গ্রাম্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী, এমনকি বৃদ্ধ মানুষও। ঢাকার রাজপথ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তায়ও অবস্থান নিল প্রতিবাদী জনতা। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা কালো ব্যাজ পরে ক্লাস বর্জন করেছিল। তাদের চোখে ছিল অজানা ভবিষ্যতের ভয়, আবার একসাথে দাঁড়ানোর সাহসও। সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিল—এটা আর শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়, বরং পুরো জাতির হৃদয়ের স্পন্দন।
সেদিন ছিল ১৮ জুলাই দেশজুড়ে যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল। ১৯টি জেলায় সংঘর্ষের ফলে সহিংসতায় প্রাণ হারায় কমপক্ষে ২৯ জন। প্রতিটি শহর রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল। রাস্তায় রাস্তায় ছিল আহতদের কান্না, শোকের প্রতিধ্বনি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রোরেল চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাতায়াতের পথ হয়ে উঠল বিভীষিকার নামান্তর।
বিকেল হতেই সারাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো। অন্ধকারের ঘোর লেগে গেল পুরো দেশে। খবর আদান-প্রদানে বাধা সৃষ্টি হলো, পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে গেল। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; তাদের প্রতিরোধের ঝড়ে বিটিভি ভবন, সেতু ভবন এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। সন্ধ্যায় ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোল প্লাজায় আগুনের লেলিহান শিখা যেন আগুনের প্রতিবাদকে আরও উস্কে দিল। অবরুদ্ধ রাত: আলো নিভিয়ে রাতে যেন পুরো দেশ অন্ধকারে হারিয়ে গেল। রাত ৯টার দিকে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও ক্যারিয়ারগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার। মুহূর্তের মধ্যেই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুরু হয়। এক আকাশের নিচে থাকা কোটি মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় একে অপরের থেকে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা দেশে থাকা প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ হারায়, পুরো দেশ যেন এক বন্দিশালায় পরিণত হয়।
ঢাকা শহর তখন শান্ত, অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ। সুনসান রাস্তাগুলোকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল পুলিশের টহল আর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া। নীল রঙের জলকামানগুলো প্রস্তুত, যেন যেকোনো মুহূর্তে মুছে দিতে পারে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের দমাতে শক্তি প্রয়োগ করছিলো অবিরাম। দমনের এই কৌশল যেন রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছিল।
১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি পুলিশ আর (সন্ত্রাসী) ছাত্রলীগের কর্মীরা। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, এবং রাবার বুলেটের বৃষ্টিতে রাস্তা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। মানুষ দৌড়াচ্ছিল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে, কিন্তু সেই নিরাপত্তা যেন কোথাও ছিল না।
এই সহিংসতার মাঝে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ঘোষণা করেন নয় দফা দাবি। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে, কয়েকজন মন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদত্যাগ করতে হবে। আন্দোলনকারীরা জোর দাবি তোলে যে, হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ এবং পুলিশ সদস্যদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং আন্দোলনকারীদের জন্য আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। দাবির এ তালিকা যেন প্রতিবাদের ভাষা থেকে প্রতিরোধের সনদ হয়ে উঠেছিল। স্লোগানের গর্জনে জনস্রোত ভেসে গেল, যেন এই দাবি পূরণের আগে তারা পিছু হটবে না। তাদের এই দাবি পূরণ না করা অবধি কেউ রক্ত নিয়ে ঘরে ফেরবে না।
সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশের টহল, জলকামানের প্রস্তুতি আর কাঁদানে গ্যাসের গন্ধ বাতাসকে আরও ভারী করে তুলেছিল। মধ্যরাতের ঠিক আগে সরকার দেশের সব জেলায় কারফিউ ঘোষণা করে এবং সেনা মোতায়েন করে। যেন এক মুহূর্তে পুরো দেশটাই অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
৬৬টি প্রাণ হারানোর খবর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই আন্দোলনের মূল্য। সহিংসতার এই রক্তাক্ত দিন যেন জাতির হৃদয়ে এক স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। সেদিনের ঘটনার রক্তাক্ত স্মৃতি, শোকের মিছিল আর ধ্বংসের প্রতিধ্বনি যেন সবকিছুকে থমকে দিয়েছিল।
২০ জুলাই রাত তখন গভীর। ঢাকার সবুজবাগের একটা অন্ধকার গলিতে নাহিদ ইসলামের বাসা। নাহিদ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক, তার নেতৃত্বেই হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল অন্যায়ের প্রতিবাদে। সেদিন রাতেও নাহিদ বসে ছিল তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে, পরবর্তী দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই নাহিদের বাসার দরজায় কড়া নাড়ে কিছু অচেনা মুখ। সাদা কালো পোশাকের কয়েকজন লোক জোর করে ঢুকে পড়ে তার ঘরে। কিছু বোঝার আগেই তারা নাহিদকে চেপে ধরে, জোর করে বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করে। নাহিদ চিৎকার করে উঠলেও প্রতিবেশীদের কেউই বের হওয়ার সাহস করে না, কেবল দরজার ফাঁক দিয়ে তাদের ভয় ভরা চোখে দেখছিল। নাহিদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল দূর থেকে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? প্রতিবাদ করাটাই কী অপরাধ!”
সাদাকালো রঙয়ের পোশাকের লোকেরা কোনো কথা না বলে তাকে গাড়ির মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সেই রাতের অন্ধকারে নাহিদ হারিয়ে যায় কোনো এক অজানা গন্তব্যের দিকে।
তাকে চোখ বেঁধে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার শরীরটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল ঘোরের মধ্যে রয়েছে। কোনোরকমে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করে সে বুঝল, এটা কোনো গ্যারেজের মতো জায়গা। চারপাশে অন্ধকার, শুধু দূরের এক আলোর দ্যুতি তার চোখে পড়ে। তার হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, আর চারপাশে কয়েকজন মুখোশধারী লোক। তাদের চোখের ভেতর যেন লুকিয়ে ছিল হিংস্রতা। নাহিদের জন্য সেই রাতটা ছিল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো। একের পর এক প্রশ্ন, মারধর, আর নির্যাতনের প্রহর কাটাতে হলো তাকে। তারা জানত, নাহিদ আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক, আর তার কণ্ঠস্বর ছিল আন্দোলনের হৃদপিণ্ড। মুখোশধারীরা তাকে বারবার বলছিল, “কেন আন্দোলন করছো? কারা আছে তোমাদের সাথে? কাদের থেকে নির্দেশ পাচ্ছো?” কিন্তু নাহিদ মুখ খোলেনি। তার দৃঢ় সংকল্প ছিল, সে কারও নাম বলবে না। সে তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না।অমানুষিক অত্যাচার সত্ত্বেও নাহিদ বারবার চেষ্টা করেছে মুখ বন্ধ রাখার। প্রতিটি আঘাতে সে বুঝতে পারছিল, এই লড়াই শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, নিজের এবং নিজেদের অস্তিত্বেরও। তার শরীরটা যেন তখনও তার সঙ্গী ছিল না, একেকটা আঘাতে শরীরের প্রতিটি কোষ কাঁপছিল। একসময় সে জ্ঞান হারায়। সে আর কিছুই মনে করতে পারে না।
২৭ জুলাই
শহরের রাস্তাগুলোতে একটি ব্যাপার ছড়িয়ে পড়েছে।আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরতে শুরু হয়েছে ব্লক রেইড। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি অভিযান চলতে থাকে, সবার চোখে চোখে রেখে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সন্দেহভাজনদের। এর ঠিক একদিন আগে, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তিনটি আন্দোলন সমন্বয়ককে ঢাকা শহরের একটি হাসপাতাল থেকে তুলে নেয়। তাদের নিখোঁজ হওয়ার খবর শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু, এটাই শেষ নয়। পরের দিন ডিবি আরও দুই সমন্বয়ককে আটক করে। বিনিময়ে, এই সমন্বয়কদের ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন—নিরাপত্তার নামেই তাদের উপর চলছে নির্মম অত্যাচার। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন থেকে সরে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাদের পরিবারকে ভয় দেখানো হচ্ছে, এমনকি মা-বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।এই ভয়াবহ পরিস্থিতি শহরের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি করে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এমন বর্বরতা কেবল তাদের নয়, পুরো শহরের শান্তি ও নিরাপত্তারও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩০ জুলাই শহরের আকাশে মেঘের স্তর জমেছে, আর সেই মেঘের তলে ছড়িয়ে পড়েছে এক বেদনার চিত্র। সরকার দেশের নানা স্থানে কোটা আন্দোলনকেন্দ্রিক নিহতদের স্মরণে শোক পালনের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে নতুন একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং তা অনলাইনে প্রচার করার।দুপুরের দিকে শহরের অলিগলিতে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, আর বাসার ছাদে লাখো শিক্ষার্থী লাল কাপড় নিয়ে বিক্ষোভে সামিল হয়। ফেসবুক, টুইটার আর অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম গুলো লাল রঙে সয়লাব হয়ে ওঠে। কোটি কোটি লাল ছবির সমাবেশ—যেখানে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে, এক কণ্ঠে তারা ঘোষণা করে—‘আমরা একসঙ্গে’। এই অনলাইন কার্যক্রম আর সামাজিক সমর্থন শহরের প্রতিটি কোণে পৌঁছে যায়।
৩৪ জুলাই, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সূর্যের আলোয় ঝলমলে শহীদ মিনার চত্বরে আজ যেন অন্যরকম প্রাণের স্পন্দন। লাখো মানুষের ভিড়। তাদের চোখে প্রতিবাদ আর মুখে একটাই সুর—বৈষম্যবিরোধী সংগ্রাম। ছাত্রদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে ছুটে এসেছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক আর সাধারণ নাগরিক। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে বড় করে লেখা—‘আমরা একসঙ্গে’, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’। যেন পুরো শহীদ মিনারটাই এক প্রাণবন্ত প্রতিবাদের মঞ্চ।
নিঃশব্দে বয়ে যাওয়া এক প্রবল স্রোত, যা শুধু আন্দোলনের নয়, বরং হাজারো মানুষের একত্রিত হওয়ার প্রত্যয়। একটি গর্জন, যা ভেদ করে যাচ্ছে সমস্ত বাধা—নীরব অচলায়তনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। শহীদ মিনারের প্রতিটি ইট যেন তাদের সমর্থন জানাচ্ছে। একত্রিত কণ্ঠগুলো মিলে সৃষ্টি করেছে এক অভূতপূর্ব প্রতিধ্বনি, যেন শহরের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে ন্যায়বিচারের জন্য আহ্বান।
কিন্তু একই দিনে শহরের অন্য অংশে ছবি ভিন্ন।বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে হামলা, রক্তে ভিজে যাচ্ছে রাস্তা। প্রতিবাদকারীদের মুখের নিঃশ্বাসেও এখন টিয়ার গ্যাসের ঘ্রাণ। আন্দোলনকারীদের মাথার ওপর বুলেটের শাঁ শাঁ শব্দ। সেই সাথে উচ্চস্বরে চিৎকার, ব্যথায় কাতরানো মানুষের বিলাপ। কিন্তু তবুও, থেমে নেই তারা। প্রতিটি লাঠির আঘাত তাদের আরো দৃঢ় করছে, শক্তিশালী করছে তাদের কণ্ঠস্বর।
এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের এক দফা দাবি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়—সরকারের পদত্যাগ। এক স্লোগান, এক দাবি, যা মুহূর্তেই শহীদ মিনারের হাজারো মানুষের কণ্ঠে রূপ নেয় সঙ্গীতের মতো। ‘সরকারের পদত্যাগ চাই’—এই গর্জন যেন বাতাসের সঙ্গেও মিশে যাচ্ছে। সরকারের প্রতি এক চরম হুঁশিয়ারি।
শহীদ মিনার থেকে শুরু করে প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি পাড়া, আর শহরের আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এই এক সুর। টেলিভিশন, রেডিও আর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি পোস্টে ঝড় তোলে এই খবর—দেশের সাধারণ মানুষও চায় পরিবর্তন। চায় শান্তি আর ন্যায্যতার সুবাতাস।
তখন ৩৫ জুলাই, রাজনৈতিক উত্তেজনার আগুনে যেন জ্বলছিল দেশ। সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তোষ এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে ‘এক দফা, এক দাবি’র স্লোগানে ভরে উঠল দেশের প্রতিটি শহর, গ্রাম, অলিগলি। সরকারের পদত্যাগের জন্য জনতার ক্রোধ যেন এক মহাসাগরে রূপান্তরিত হচ্ছিল। প্রতিটি মানুষের মুখে একই দাবি—এই সরকারকে চলে যেতেই হবে।
এই উত্তাল সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রখ্যাত শিক্ষক আগাম নেটওয়ার্কে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনার রূপরেখা প্রকাশ করেন। সেই রূপরেখা যেন মানুষের মধ্যে নতুন এক আশার আলো জ্বালিয়ে দিলো। এটি ছিল নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা, যা মানুষকে আবারো ভাবতে শিখিয়েছিল, এই অন্ধকারে একটা আলো আসতে পারে।
তবে আন্দোলন থেমে থাকার নয় বিক্ষোভকারীরা সিদ্ধান্ত নিলো, তাদের আন্দোলনকে আরো সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে হবে। তাই তারা ঘোষণা করল, একটি নতুন কর্মসূচি—‘মার্চ টু ঢাকা’। এই কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকায় গিয়ে নিজেদের দাবি উত্থাপন করা এবং সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ প্রকাশ করা। সারাদেশের মানুষকে আহ্বান জানানো হলো—তারা যেন রাজধানীর পথে রওনা হয়, যেন তারা নিজেদের কণ্ঠস্বর শুনিয়ে দেয়।
প্রথমে, ‘মার্চ টু ঢাকা’র তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭ জুলাই। কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সেই তারিখ একদিন এগিয়ে এনে ৩৬ জুলাই নির্ধারণ করা হয়। বিক্ষোভকারীরা তাদের প্রস্তুতি বাড়িয়ে দিলো, এবং আন্দোলনের গতিকে আরো দ্রুততর করে তুলল।
৩৬ জুলাইয়ের সেই দিনটি যেন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সারাদেশের মানুষ, নানা বয়সের, পেশার, শিক্ষা আর বিশ্বাসের—তারা সবাই ঢাকার পথে রওনা দিলো। শহরের মোড়ে মোড়ে কেবল মানুষের ঢল। ঢাকার রাস্তাগুলো যেন এক সমুদ্র হয়ে উঠল, যেখানে একটাই ঢেউ—প্রতিবাদের ঢেউ। মানুষ হেঁটে আসছে, কেউ ট্রাকে, কেউ বাইকে, কেউ রিকশায়, কেউবা পায়ে হেঁটে।
ঢাকা শহরটি সেদিন এক নতুন জয়ের আশায় প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল। ঢাকার আকাশে যেন মানুষের প্রত্যাশার মেঘ জমা হয়েছিল। জনতার ভিড় আর স্লোগানে শহর কাঁপছিল। এটি ছিল এক নির্ভীক আন্দোলনের প্রতীক, যা প্রমাণ করেছিল জনগণের শক্তি কখনোই অবহেলা করা যায় না। নতুন সরকারের দাবির এই সংগ্রাম সেদিন দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে যায়।
❝বিজয়ের হাসিতে ভরা একটি ঐতিহাসিক দিন❞
৩৬ জুলাইয়ের সকালটা যেন এক নতুন দিনের সূচনা। ঢাকার আকাশে সূর্যটা উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সেদিনের আলো ছিল অন্যরকম—এ আলো ছিল মানুষের জয়োল্লাসের, স্বাধীনতার, ফ্যাসিবাদের অবসানের। ভোর থেকেই কারফিউ ভেঙে হাজারো মানুষ ঢাকার রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করল। তাদের চোখে ছিল সাহস, মনে ছিল অদম্য প্রতিজ্ঞা—আজ কিছু একটা হবে। এদিন সবার মুখে ছিল একটাই স্লোগান, “এক দফা, এক দাবি,” যেন সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল শহরের প্রতিটি কোণায়।
মানুষের সেই উন্মাদনা থামানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা নানা ভাবে বাধা দিতে চেয়েছিল। রাস্তা আটকে দেয়া, হামলার চেষ্টা—কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। জনতার জোয়ার ছিল থামানোর অযোগ্য। সকাল ১০টা থেকে হঠাৎ করেই সারা দেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুরু হয়, যা মানুষের মধ্যে উত্তেজনা এবং আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না, কিন্তু মানুষের মনোবল এতটুকুও ভাঙেনি।
হঠাৎই দুপুর ২টায় সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের ঘোষণা আসে। দেশের প্রতিটি মানুষ যেন সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মানুষ ভাবছিল, হয়তো কিছু একটা বদলাতে চলেছে। আর সেই বদল এলো ঠিকই—খবর এলো, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। পরিবারিক আলোচনার পর তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি হেলিকপ্টারে চেপে দেশ ত্যাগ করেন।এই ঘোষণা যেন বিদ্যুৎগতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল।মানুষ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, ফ্যাসিবাদের পতন তারা নিজের চোখে দেখছে! ৩৬ জুলাইয়ের সেই মুহূর্তটি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পুরো বাংলাদেশ যেন মুক্তির আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ল। ঢাকা শহরটি মুহূর্তেই আনন্দ উদযাপনের মঞ্চে পরিণত হলো।
রাজপথে মানুষের ঢল, সবার মুখে বিজয়ের হাসি। কেউ কোলাকুলি করছে, কেউ রাস্তায় বসে নাচছে, কেউবা মিষ্টি বিলাচ্ছে একে অপরকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙিন পতাকা উড়িয়ে নাচছে, আর বয়স্ক মানুষগুলো হাততালি দিয়ে উদযাপন করছে তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে চলছে খুশির সুর, রিকশায় বাজছে বিজয়ের গান।
মানুষদের এই আনন্দ যেন ঈদের খুশিকেও হার মানিয়ে দেয়। ঢাকার প্রতিটি রাস্তায়, অলিতে গলিতে যেন উৎসবের পরিবেশ। গণভবন, সংসদ ভবন, আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মানুষের ঢেউ আর থামছে না। সেখানেও চলছে উদযাপন। বিক্ষোভের উত্তেজনার বদলে সেখানেও ছিল আনন্দের সুর। ভাঙচুরের মধ্যেও সবার মুখে ছিল এক বিশেষ খুশির হাসি, যেন এই ভাঙচুর নয়, বরং ফ্যাসিবাদের মূর্তি ভাঙছে তারা।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ সেদিন এক নতুন রূপে নিজেদের দেখতে পেয়েছিল। ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রের পতন দেখে মানুষ যেন নতুন করে শ্বাস নিতে পারছিল। তারা উপলব্ধি করেছিল, এ দিনটি তাদের জন্যই। পুরো দেশ যেন উৎসবের রঙে রাঙিয়ে উঠেছিল, এই দিনটি যেন এক ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন হয়ে গিয়েছিল।
৩৬ জুলাইয়ের এই বিশেষ দিনটি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে চিরকাল জ্বলজ্বল করবে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি ছিল জনগণের ঐক্যের এক দুর্দান্ত উদাহরণ, যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল এক নতুন দিনের। এ দিনটি ছিল এক নির্ভীক সংগ্রামের সফল সমাপ্তি, যেখানে সাধারণ মানুষের সাহসের সামনে ফ্যাসিস্ট শাসন কাঁপতে বাধ্য হয়েছিল।
সেদিনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল এক স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়। হাজারো মুখে বিজয়ের উল্লাস, কণ্ঠে স্বাধীনতার জয়গান—এ যেন এক নতুন জন্মের মুহূর্ত। ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে শহরের প্রতিটি কোণে, মানুষের চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু আর মুখে ছিল মুক্তির হাসি। এই দিনটি যেন শুধু বিজয়ের দিন নয়, বরং নিজেদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার এক গর্বের স্মৃতি।
এ দিনটি আমাদের শিখিয়ে গেছে, জনগণের সম্মিলিত শক্তির সামনে কোনো জুলুম টিকতে পারে না। এটি শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি আদর্শ, এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। নতুন এক আশার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে এই দিন, যে আলো সকল অন্যায়, অবিচার, এবং অত্যাচারকে পরাজিত করে সব মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে।
এই দিনটি তাই আমাদের মনে রাখায়, আমাদের সংগ্রামে, আমাদের আশা আর বিশ্বাসে চিরকাল বেঁচে থাকবে।৩৬ জুলাই-এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি, স্বাধীনতার নবজাগরণের দিন।
[স মা প্ত]
লেখক : তরুণ লেখক ও ঔপন্যাসিক।