ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে।এতে চরম আর্থিক দৈন্যতায় পড়েছেন এ শিল্পের কারিগররা।
এক সময় এ উপজেলায় এ শিল্পের জিনিসপত্রের বেশ কদর ছিল।কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় সিলভার, এলমনিয়াম ও প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্পীদের মাটির তৈরি জিনিসপত্র পড়েছে হুমকির মুখে।আস্তে আস্তে এ শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।একইসাথে মৃৎ শিল্পীদের জীবন চলার পথে নেমে এসেছে নিদারুণ কষ্টে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।তাইতো সংসারের ঘানি টানতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
কুমার পাড়াগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, কুমাররা প্রথমে ভূমি থেকে কালো এটেল ও বালু মাটি সংগ্রহ করে, পরে পানি মিশিয়ে হাত ও পায়ের সাহায্যে কাঠের পিটনা দিয়ে থেতলে ছেঁনে চেঁচে মশ্রিণ করে নির্মাণ উপযোগি করে তুলে।এরপর বিভিন্ন আকার, আকৃতি দিয়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে।তারপর সূর্যের তাপে এগুলোকে রোদে শুকানো এবং সবশেষে তা আগুনে পোড়ানো হয়।এরপর প্রয়োজন মতো মনের মাধুরী মিশিয়ে রং লাগিয়ে তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈরি জিনিস।কেউ কেউ আবার এ কাজে চরকা ব্যবহার করেন।
কিন্তু মাটির তৈরি জিনিসপত্র আগের মতো ব্যবহার করছে না মানুষ।প্লাস্টিক, এলোনিয়াম ও সিলভারের বাহারি রকমের অত্যাধুনিক জিনিস বাজারে আসার কারণে দিনে দিনে মাটির তৈরি জিনিসপত্র নিতে ক্রেতাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।এ কারণে মৃৎশিল্পীদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন।
রাণীশংকৈল উপজেলার কেউটান, ভাংবাড়ি, জুঁগিপাড়া, হাঁড়িপাড়া, কাদিহাট, ঝুলঝাড়ি, বলিদ্বারাসহ বিভিন্ন এলাকার মৃৎশিল্পীরা এখন বেকার হয়ে পড়েছে।তাদের সংসারে চলছে অভাবের হাহাকার।সামান্য আয়ে চলছে না তাদের সংসার।
কুমারদের মাটি দিয়ে তৈরি জিনিস বর্তমানে প্লাস্টিক, সিলভার ও এলমনিয়ামের তৈরি সামগ্রীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেনা।বাধ্য হয়ে অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়।এ পেশার সাথে জড়িত প্রায় শতাধিক কুমার পরিবার এমন অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে আরও দেখা গেছে, কুমারপাড়ায় মৃৎশিল্পী নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবার-পরিজনের দুঃখের করুন কাহিনী।তারা অভাব অনটনের কারণে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে হিমশিম খাচ্ছে।আবার অনেকেই অভাবের কারণে তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়াসহ লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে।
উপজেলার হোসেগাঁও কুমারপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পী রানী পাল মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি কাজের ফাঁকে ফাঁকে বলছিলেন “এখন আর আগের মতো হামার কুমার পাড়ার আয় রোজগার নাই।আগে হামরা চরকা দিয়া বিভিন্ন ধরনের জিনিস বানাচিনো।কিন্তু এখন চরকা ব্যবহার করা হয় না।কারণ চরকা দিয়া জিনিসপত্র বানালে ভালো দাম পাওয়া যায় না।তাছাড়া এখন আমাদের মাটি ও লাকড়ি কিনে আনতে হয়।তাই বিক্রি করে মুনাফা খুবই কম হয়।শুধু পেটে-ভাতে খেয়ে কুনহো রকম খেয়ে বেঁচে আছি বাহে”।
ওই গ্রামের মৃৎশিল্পী বরুন পাল বলেন, সামান্য আয়ে সংসার টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমাদের তৈরি জিনিস আগের মত মানুষ ব্যবহার করে না।
তিনি আরো বলেন, আমার এক মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, লেখাপড়ার খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয়।ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কোন জমি নেই।আমি ও আমার স্ত্রী ১৫-১৬ বছর যাবৎ এ কাজ করে কোন রকম সংসার চালাচ্ছি।আমাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ কোনরকম বেঁচে আছি।আমাদের যদি সরকার একটু সাহায্য সহযোগিতা করতো তাহলে আমাদের এই বাপদাদার পেশাটা আমরা ধরে রাখতে পারতাম।
কেউটান গ্রামের মৃৎশিল্পী রাজেন পাল বলেন, “আমাদের বাপ দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে আমি এখন মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করি।কারণ বাপ-দাদার পেশায় আগের মতো আয় রোজগার হয় না।মাটির কলস হাঁড়ি-পাতিল, মাটির ব্যাংক, বাচ্চাদের খেলনা, জাজোর, বইটা, দইয়ের পাতিল, মুটকি, গুড়ের পাউড়া, ভাপা পিঠার পাতিল, জলবিরা, ফুলের টব এসব জিনিসপত্র এখন আগের মত মানুষ ব্যবহার করে না। তাই বাধ্য হয়ে এই পেশা ছেড়ে আমি এখন মোবাইল সার্ভিসের কাজ করে সংসার চালাই।
হোসেনগাঁও কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পী কালিদাস পাল বলেন, এলমনিয়াম, প্লাস্টিক, সিলভার এসব জিনিসের কারণে মাটির জিনিসপত্র এখন আগের মতো ব্যবহার হচ্ছে না।এ পেশা ছেড়ে অনেকেই আমার মত অন্য পেশায় চলে গেছে।আমি এখন মোবাইল ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ, মোবাইলের বিভিন্ন উপকরণ বিক্রি করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেঁচে আছি।
এছাড়াও ভাংবাড়ি গ্রামের মৃৎশিল্পী লব পাল, জগমোহন পাল, নুকুল পাল, হরেন পাল, ঝুলঝাড়ি গ্রামের হিম্মত পাল,খলো পাল, কেউটান গ্রামের, মিনা পাল, শেফালী পাল ও হিরা পাল বলেন, “বাপ-দাদার পুরাতন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এ পেশায় এখনও কাজ করে কোনমতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছি”।
ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন এসব মৃৎশিল্পীরা।তবে নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্রের ব্যবহার কমলেও বেড়েছে পোড়ামাটির গৃহসজ্জার চাহিদা।সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারো হারানো ঐতিহ্য ফিরানো যাবে এমনটাই মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক মৃৎশিল্প এ উপজেলার কুমার সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রেখেছে।আগে এ শিল্পের তৈরি জিনিসপত্র স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আশপাশের জেলাতেও সরবরাহ করা হতো।তাই বাংলার এই আদি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সব ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছেন এ পেশায় জড়িতরা।